ঢাকা,শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪

কক্সবাজারের শুটকি বর্হিবিশ্বে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব

শাহজাহান চৌধুরী শাহীন,কক্সবাজার ॥sutky

কক্সবাজারের শুটকি দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানী হচ্ছে বর্হিবিশ্বে। বিশেষ করে ব্রিটেন, আমেরিকা, কুয়েত, কাতার, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে নিয়মিত রপ্তানি করা হচ্ছে হচ্ছে শুটকি। অনেকেই ডাকবিভাগ, কুরিযার সার্ভিসের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত শত শত কেজি শুঁটকি বিদেশে পাঠাচ্ছেন।

ব্যাপক ভিত্তিতে শুঁটকি রপ্তানির ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া হলে প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশের শুঁটকি শিল্পে বিপুলসংখ্যক লোকের কর্মসংস্থান করা সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

পর্যটকদের চাহিদা পূরণে নানান প্রতিকূলতা এবং সীমাবদ্ধতার মধ্যে কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন স্থানে এখনো পুরোদমে চলছে শুঁটকি উৎপাদন। মহেশখালীর উপজেলার কুতুবজোম ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত এ স্বর্ণদ্বীপখ্যাত সোনাদিয়া, শহরের নাজিরার টেক বৃহৎ শুটকি মহাল, খুরুশকুল, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, টেকনাফের বাহারছড়া ও প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনের শুঁটকিমহাল কেবল বাণিজ্যিক কেন্দ্র নয়, এগুলো এক একটি পর্যটন স্পটও।

শীত মৌসুমের প্রায় চার মাসে কক্সবাজারে অন্তত ১৫ লাখেরও বেশি পর্যটক ভ্রমণে আসেন। পর্যটকদের কাছে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে শুটকির। এর মধ্যে শতকরা ৭০ জন পর্যটক ফেরার সময় শুঁটকি কিনে নেন।

কক্সবাজার পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের নাজিরার টেক শুটকি মহালটি এশিয়ার বৃহৎ শুটকি মহাল। এটি প্রায় একর জমির ( বালিয়াড়ি) উপর প্রতিষ্ঠিত। কক্সবাজার শহর থেকে ইজি বাইক কিংবা রিক্সা যোগে সহজেই যাওয়া যায় নাজিরার টেক শুটকি মহালে। শুটকি কিনতে নয়, অনেক পর্যটক মহালটি দেখার জন্যই আসেন এখানে।

কক্সবাজার শহর থেকে স্পীডবোডে ১৫ কিলোমিটারের সমুদ্র পাড়ি দিয়ে সহজে যাওয়া যায় সোনাদিয়ায় শুঁটকি মহালে। সোনাদিয়ায় রয়েছে দু’টি চর। একটি বড়চর, অপরটি মগচর। একই ভাবে সদরের চৌফলদন্ডি, খুরুশকুল, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, টেকনাফের বাহারছড়া ও প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনে গড়ে উঠেছে শুঁটকি উৎপাদনের অনেক মাচাং। মাচাং ছাড়াও চাটাই বিছিয়ে শুঁটকি তৈরি করে স্বচ্ছলতা পেয়েছে এসব উপকূলীয় এলাকার হাজার হাজার পরিবার। এখানে ভ্রমণে আসেন দেশ-বিদেশের বহু পর্যটক। পর্যটকরা সরাসরি শুঁটকি মহাল থেকেই কিনে নেন পছন্দের শুঁটকি।

ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এই পুরো কক্সবাজার জেলায় ছয় মাসে প্রায় হাজার কোটি টাকার শুঁটকি উৎপাদিত হয়। শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় হলো (অক্টোবর থেকে মার্চ) আশ্বিন থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত শুঁটকি উৎপাদনের মৌসুম হিসেবে ধরে নেয়া হয়।

সরেজমিনে নাজিরার টেক শুঁটকি মহালে গিয়ে দেখা যায়, শুঁটকি শ্রমিক ও ব্যবসায়িদের কর্মচাঞ্চল্য। যার যার মতো সবাই ব্যস্ত। কথা বলারও ফুসরত নেই কারো। শ্রমিকরা জানান, সেই ভোর থেকে কর্মব্যস্ততা শুরু। সূর্য ডোবা পর্যন্ত চলে কর্মযজ্ঞ।

পরিবেশ অধিদপ্তরের সহযোগী বেসরকারি সংস্থা নেকমের (নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্ট) একজন কর্মকর্তা জানান, জেলায় উৎপাদিত বেশির ভাগ শুঁটকিতে কোনো কেমিক্যাল মেশানো হয় না। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে সাগর উপকূলে মাচাং ( চাতাল) তৈরি করে এই শুঁটকি তৈরি করা হয়। পুরুষরা মাছ সংগ্রহের কাজে জড়িত থাকলেও প্রক্রিয়াকরণে জড়িত থাকেন অধিকাংশ নারী। সাগর থেকে মাছ আহরণ করে জেলেরা ওই সব মহাল ঘাটে (চরে) নিয়ে আসেন। সপ্তাহ পর পর নৌকা, ট্রলারগুলো মাছ নিয়ে চরে আসে। এ সময় বহু মানুষের সমাগম হয়। ব্যবসায়ীরা তাদের কাছ থেকে মাছ কিনে নেন। প্রতিটি মহালে গিয়ে দেখা গেছে, শ্রমিকেরা কেউ বড় বড় শুঁটকি পানিতে ধুয়ে নিচ্ছে, কেউ কেটে রোদে শুকাচ্ছেন।

তারপর বাঁশ দিয়ে বিশেষভাবে তৈরি ঘেরগুলোতে পসরা সাজানো হয়েছে নানারকম মাছের। এখানে ছুরি, লইট্যা, পোহা, ফাইস্যা, লায়োক্কা, মাইট্যা, রূপচান্দা মাছসহ বিভিন্ন ধরনের শুঁটকি উৎপাদিত হয়। মহালগুলোয় মাঝারি সাইজের প্রতি কেজি ছুরি শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকায়। বড় শুঁটকি ৮০০ থেকে ১২০০, আর লইট্যা শুঁটকি ৩৫০ থেকে ৬০০ টাকায়।

নাজিরার টেক শুঁটকি ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি আতিক উল্লাহ জানান, প্রতি সপ্তাহে নাজিরার টেক শুটকি মহাল থেকে অন্তত দুই কোটি টাকার শুঁটকি চট্টগ্রাম যাচ্ছে। সেখান থেকে সারাদেশে সরবরাহ করা হচ্ছে।

ব্যবসায়ী হাজী ইসহাক সওদাগর (৫০) জানান, ওই সব মহালগুলোতে স্থানীয় বাসিন্দা ছাড়াও কক্সবাজার সদর, খুরুশকূল, চৌফলদণ্ডী, চকরিয়া, পেকুয়া, কুতুবদিয়া, বাঁশখালী ও চট্টগ্রামের লোকজন এখানে ব্যবসা করতে আসেন।

স্থানীয় পৌর কাউন্সিলর আকতার কামাল জানান, নাজিরার টেক, সোনাদিয়া, সেন্টমার্টিনসহ আশপাশের মহালগুলোতে উৎপাদিত শুঁটকিতে ক্ষতিকর কোনো পদার্থ ব্যবহার করা হয় না। ফলে এই শুঁটকি এখন দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হয়। বিদেশে এই শুঁটকির বেশ চাহিদা রয়েছে।

কক্সবাজার শুটকি প্রক্রিয়াজাতকরণ সমিতির সভাপতি জয়নাল আবেদীন জানান, কক্সবাজারে উৎপাদিত শুটকি দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ছাড়াও বিদেশে রপ্তানী হচ্ছে। বিশেষ করে ব্রিটেন, আমেরিকা, কুয়েত, কাতার, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে নিয়মিত রপ্তানি হচ্ছে। অনেকেই ডাকবিভাগ, কুরিযার সার্ভিসের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত শত শত কেজি শুঁটকি বিদেশে পাঠাচ্ছেন। এসব এলাকার কেউ প্রবাসে যাওয়ার সময় শুঁটকি নিয়ে যায়।

তিনি আরো জানান, শুঁটকি মৌসুমে প্রতিদিন শত শত পর্যটক মহালগুলো ভ্রমণের জন্য আসেন। পর্যটকরা এখানকার শুঁটকি বেশ পছন্দ করেন।

নেকমের জেলা কর্মকর্তা মোঃ সফিকুর রহমান জানান, আগে শুটকি উৎপাদনকারীরা ডিডিটি পাউডারসহ নানা কীটনাশক মিশিয়ে শুঁটকি উৎপাদন করতেন। গত নভেম্বর থেকে তারা বিষমুক্ত শুঁটকি উৎপাদন করছেন।

পরিবেশ অধিদপ্তরের সহযোগী বেসরকারি সংস্থা নেকমের (নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্ট) কর্মকর্তারা বিষমুক্ত শুঁটকি উৎপাদনের ক্ষেত্রে জেলেদের সচেতন করে আসছেন। কিন্তু এতে বিষ থাকায় বিপুলসংখ্যক লোক ক্যান্সার, যক্ষ্মাসহ কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তাই লোকজনকে সুস্থ রাখার জন্য জেলেদের সচেতন করা হচ্ছে।

——————

পাঠকের মতামত: